OrdinaryITPostAd

যে কারণে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি বেশী হয়

ভূমিকম্প (Earthquake) বর্তমানে এখন একটি আতঙ্কের নাম। ভূমিকম্প বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি, ভূ-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে তা হঠাৎ নিঃসৃত হলে ভূ-পৃষ্ঠে সাময়িক কম্পন সৃষ্টি হয়। এমন আকস্মিক ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। সাধারণত কম্পন-তরঙ্গ হতে যে শক্তির সৃষ্টি হয়, সেটিই ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রকাশ ঘটে। প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেলটির মাধ্যমে যে কারণে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি বেশী হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। 
পোস্ট সূচিপত্রঃভূমিকম্প সম্পর্কে আমাদের কিছু না কিছু ধারণা সবারই কম বেশী আছে। তবে, যে কারণে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি বেশী হয় সে সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নাও থাকতে পারে। একটি বিষয় সকলেরই কম বেশী অনুধাবন করাটা জরুরী এই কারণে যে, ভূমিকম্প হলে ক্ষতির আশংকা থেকেই যায়। নিম্নে ভূমিকম্পের প্রভাব, ভূমিকম্পের সময় ভূ-পৃষ্ঠে কী কী ঘটে, ভূমির কম্পন চলন কাকে বলে?, ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসাত্মক তরঙ্গ, ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ ইত্যাদি সম্পর্কে তুলে ধরা হল। 

ভূমিকম্পের প্রধান তিনটি প্রভাব

ভূমিকম্প হলো একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা এক মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে জনজীবনে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। মূলত, ভূমিকম্পের প্রধান তিনটি প্রভাব হলো-
  1. ভৌত ক্ষতি
  2. মানবিক ও সামাজিক প্রভাব
  3. পরিবেশগত পরিবর্তন

১. ভৌত ক্ষতি

ভূমিকম্পের ফলে বিশেষ করে স্থাপত্য, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মৌলিক অবকাঠামোগুলো ধ্বংস হতে পারে। যেমন-
  • বড় ভূমিকম্পের সময় ভবন ও ব্রিজ ভেঙে পড়ে, যার ফলে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়।
  • রাস্তা ও পরিবহন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলে ত্রাণ কার্যক্রমে ব্যাহত হয়।
  • বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ও গ্যাস লাইনের ক্ষতি সাধন করে যা জনজীবনের ভুগান্তি সৃষ্টি করে।

২. মানবিক ও সামাজিক প্রভাব

ভূমিকম্প মানুষের জীবনযাত্রায় অমানবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। যেমন-
  • প্রচুর মানুষ আহত হয় এবং গৃহহীন হয়ে পড়ে।
  • খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়, যা দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
  • মানুষ মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তাৎক্ষণিক বিষণ্ণতা ও ট্রমার শিকার হয়।
  • স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়।

৩. পরিবেশগত পরিবর্তন

ভূমিকম্প শুধু মানুষের ওপরই নয়, পরিবেশের ওপরও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। যেমন-
  • ভূমিধস ও পাহাড় ধসের কারণে কৃষিজমি ও বনভূমি ধ্বংস হয়।
  • নদী ও জলাধারের গতিপথ পরিবর্তিত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
  • সুনামির মতো দুর্যোগ দেখা দিতে পারে, যা উপকূলীয় অঞ্চলে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে।

ভূমিকম্পের সময় ভূ-পৃষ্ঠে কী কী ঘটে

ভূমিকম্প হল এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার সময় ভূ-পৃষ্ঠে আকস্মিক ও তীব্র কম্পন সৃষ্টি হয়। এই কম্পনের ফলে ভূমির গঠন, অবকাঠামো, এবং জীবজগতের উপর বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। চলুন দেখে নেওয়া যাক ভূমিকম্পের সময় ভূ-পৃষ্ঠে কী কী ঘটে:

প্লেটের স্থানচ্যুতি

ভূমিকম্প সাধারণত ভূত্বকের টেকটোনিক প্লেটের সরণের ফলে ঘটে। যখন দুটি প্লেটের মধ্যে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয় এবং তা হঠাৎ মুক্ত হয়, তখন ভূ-পৃষ্ঠে:
  • তীব্র কম্পন অনুভূত হয়।
  • জমি ফাটতে পারে এবং চ্যুতির সৃষ্টি হতে পারে।
  • কিছু ক্ষেত্রে প্লেটগুলোর নতুন অবস্থান তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে ভূ-গঠনের পরিবর্তন আনে।

ভূমিধস ও মাটির পরিবর্তন

ভূমিকম্পের সময় মাটির কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে, যার ফলে:
  • পাহাড় ধসে পড়তে পারে, বিশেষত উঁচু এবং খাড়া স্থানগুলোতে।
  • ভূমি ফাটতে পারে, যেখানে গভীর খাদ বা নতুন পাহাড়ি গঠন তৈরি হতে পারে।
  • নদী ও জলাধারের গতিপথ পরিবর্তিত হতে পারে, যা বন্যা বা জল সংকটের কারণ হতে পারে।

ভবন ও অবকাঠামোর ধ্বংস

  • ভূমিকম্পের কম্পন অত্যন্ত শক্তিশালী হলে:
  • ভবন, ব্রিজ ও রাস্তা ভেঙে পড়তে পারে।
  • বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ও গ্যাস লাইনের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
  • যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়, যা উদ্ধার ও সাহায্য কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।

তরলীকরণ (Soil Liquefaction)

ভূমিকম্পের সময় কিছু অঞ্চলের মাটি তরলে পরিণত হতে পারে, যার ফলে:
  • শক্ত মাটি নরম হয়ে যায় এবং ভূমি দেবে যেতে পারে।
  • ভবন ও স্থাপনা ভূমিতে নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারে।
  • ফসলি জমির উর্বরতা কমে যেতে পারে।

সুনামি ও জলবায়ুর পরিবর্তন

সমুদ্রের নিচে ভূমিকম্প হলে প্রবল জলোচ্ছ্বাস বা সুনামির সৃষ্টি হতে পারে, যা উপকূলীয় অঞ্চলে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। এছাড়াও-
  • বায়ুমণ্ডলে ধুলা ও গ্যাস নির্গত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হতে পারে।
  • ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পরিবর্তিত হতে পারে, যা কৃষি ও বাস্তুসংস্থানের ওপর প্রভাব ফেলে।

ভূমির কম্পন চলন কাকে বলে?

ভূমিকম্পের সময় ভূমির বিভিন্ন ধরনের গতিবিধি ঘটে, যার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হলো ভূমির কম্পন চলন। এটি মূলত ভূমিকম্পের তরঙ্গ দ্বারা সৃষ্ট ভূমির গতিশীলতা, যা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মাত্রায় অনুভূত হতে পারে।

ভূমির কম্পন চলনের সংজ্ঞা

ভূমির কম্পন চলন বলতে ভূমিকম্পের সময় ভূমির ওঠানামা এবং তরঙ্গগত গতিকে বোঝানো হয়। এটি ভূ-গর্ভস্থ শক্তির হঠাৎ মুক্তির ফলে সৃষ্টি হওয়া সিসমিক তরঙ্গ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণত, এই কম্পন চলন কয়েকটি প্রধান উপাদানের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়:
  • কম্পনের তীব্রতা: ভূমিকম্পের শক্তি নির্ভর করে তার মাত্রা (Magnitude) এবং শক্তি প্রবাহের গভীরতা।
  • দিক পরিবর্তন: কম্পন চলনের সময় ভূমির অনুভূমিক এবং উল্লম্ব গতিবিধি দেখা যায়।
  • সিসমিক তরঙ্গ: ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হওয়া প্রাথমিক (P) তরঙ্গ, দ্বিতীয়িক (S) তরঙ্গ, এবং পৃষ্ঠীয় (Surface) তরঙ্গ ভূমির কম্পন পরিচালনা করে।

ভূমির কম্পন চলনের ধরণ

ভূমিকম্পের সময় ভূমির গতিবিধি বিভিন্ন ধরণের হতে পারে, যেমন:
  • অনুভূমিক কম্পন: যখন ভূমি একদিকে থেকে অন্যদিকে সরতে থাকে। এটি ইমারত ও অবকাঠামোকে বিপজ্জনকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
  • উল্লম্ব কম্পন: ভূ-পৃষ্ঠ উল্লম্বভাবে ওঠানামা করে, যা ভূমির অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে পারে।
  • তরলীকরণ (Liquefaction): ভূমিকম্প চলাকালীন কিছু নরম মাটি তরলের মতো আচরণ করতে পারে, যার ফলে ভবন বা স্থাপনা ডেবে যেতে পারে।

ভূমির কম্পন চলনের প্রভাব

ভূমির কম্পন চলনের কারণে বিভিন্ন রকমের ক্ষতি হতে পারে, যেমন:
  1. অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়, বিশেষ করে দুর্বল নির্মাণের ক্ষেত্রে।
  2. রাস্তা ও সেতু ভেঙে পড়ে, যা যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায়।
  3. ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পরিবর্তিত হয়, যা কৃষি ও বাস্তুসংস্থানের ওপর প্রভাব ফেলে।

ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসাত্মক তরঙ্গ

ভূমিকম্পের ফলে ভূগর্ভ থেকে শক্তির তীব্র মুক্তি ঘটে, যা বিভিন্ন ধরনের সিসমিক তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এই তরঙ্গগুলো ভূ-পৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়ে স্থাপনা, পরিবেশ, এবং মানবজীবনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

ভূমিকম্পের প্রধান ধ্বংসাত্মক তরঙ্গ

ভূমিকম্পের ফলে যে শক্তিশালী তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তা প্রধানত দুই ধরনের হতে পারে:

১। শরীরগত তরঙ্গ (Body Waves): 

এই তরঙ্গগুলো ভূগর্ভের ভেতরে দিয়ে প্রচারিত হয়। প্রধানত P-তরঙ্গ (Primary Waves) এবং S-তরঙ্গ (Secondary Waves) অন্তর্ভুক্ত। P-তরঙ্গ ভূমির সংকোচন-প্রসারণ ঘটায়, যা প্রথমে অনুভূত হয়। S-তরঙ্গ ভূ-পৃষ্ঠের দোলন সৃষ্টি করে, যা অনেক বেশি ক্ষতিকর।

২। পৃষ্ঠীয় তরঙ্গ (Surface Waves)

এই তরঙ্গ ভূ-পৃষ্ঠ বরাবর ভ্রমণ করে এবং সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক। লাভ তরঙ্গ (Love Waves): অনুভূমিকভাবে ভূমির গতি ঘটায়, যা ভবন ও স্থাপনার জন্য ভয়াবহ। রে-লে তরঙ্গ (Rayleigh Waves): ভূ-পৃষ্ঠে তরঙ্গের মতো গতিবিধি তৈরি করে, যা ভূমিকে উল্লম্বভাবে এবং অনুভূমিকভাবে কম্পিত করে।

ভূমিকম্পের ধ্বংসাত্মক তরঙ্গের প্রভাব

ভূমিকম্পের তরঙ্গের ফলে:
  • ভবন ও অবকাঠামো ভেঙে পড়ে।
  • ভূমিধস ও রাস্তা ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।
  • সুনামি সৃষ্টি হতে পারে, যদি ভূমিকম্প সমুদ্রের নিচে ঘটে।
  • বায়ুমণ্ডলে ধূলা ও গ্যাস ছড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে।

ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ

ভূমিকম্প প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ, যা এক মুহূর্তের মধ্যে জনজীবন এবং অবকাঠামোর উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই ক্ষতির মূল কারণগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:

১. স্থাপনা ও অবকাঠামোর দুর্বলতা

ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় যদি কোনো অঞ্চলে দুর্বল স্থাপনা ও অবকাঠামো থাকে। যেমন-
  • অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ভবন ও ব্রিজ দ্রুত ভেঙে পড়ে।
  • ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তি না থাকলে ভবনগুলোর ক্ষতির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
  • সঠিকভাবে নির্মিত না হওয়া রাস্তাঘাট ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে।

২. ভূ-গঠন ও মাটির দুর্বলতা

ভূমিকম্পের মাত্রা এবং এর দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি অনেকাংশে ভূ-গঠনের উপর নির্ভর করে। যেমন-
  • ভূগর্ভস্থ প্লেটের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট শক্তিশালী কম্পন ভূমির গঠনকে পরিবর্তন করতে পারে।
  • নরম মাটির অঞ্চলগুলিতে তরলীকরণ (Soil Liquefaction) দেখা দিতে পারে, যা ভবন ও স্থাপনাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।
  • পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস হতে পারে, যা রাস্তাঘাট ও বসতি ধ্বংস করতে পারে।

৩. জনসংখ্যার ঘনত্ব ও দুর্বল প্রস্তুতি

বহুল জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভূমিকম্প বেশি প্রাণহানি ও ক্ষতির কারণ হয়। যেমন-
  • দ্রুতগামী শহরগুলিতে জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হয়।
  • পর্যাপ্ত জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থা না থাকলে ক্ষতির মাত্রা বাড়তে পারে।
  • সচেতনতা ও পূর্বপ্রস্তুতির অভাব থাকলে মানুষ সঠিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না, ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়।

৪. সুনামি ও আনুষঙ্গিক দুর্যোগ

যদি ভূমিকম্প সমুদ্রের নিচে ঘটে, তবে সুনামি সৃষ্টি হতে পারে, যা উপকূলীয় এলাকায় ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন-
  • জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলবর্তী শহর ও গ্রাম প্লাবিত হতে পারে।
  • কৃষিজমি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য সংকটের সৃষ্টি করতে পারে।
  • পানির উৎস এবং পরিবেশ দূষিত হতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

ভূমিকম্পের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি

ভূমিকম্প প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ, যা এক মুহূর্তের মধ্যে মানুষের জীবন, অবকাঠামো, পরিবেশ এবং অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই ক্ষয়ক্ষতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগে বিভক্ত করা যায়।

১. প্রাণহানি ও মানবিক ক্ষতি

  • ভূমিকম্পের সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হলো মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়া।
  • ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অধিক জনসংখ্যা থাকলে প্রাণহানি বেশি হয়।
  • ভবন, ব্রিজ ও রাস্তা ভেঙে পড়ার ফলে মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে।
  • ভূমিকম্পের পর উদ্ধার কাজ বিলম্বিত হলে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতে সমস্যা হয়।
  • মানসিক আঘাত (trauma) দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে, যা মানুষের জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে।

২. অবকাঠামোর ধ্বংস

  • ভূমিকম্পের ফলে স্থাপনা ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
  • দুর্বল নির্মিত ভবনগুলো এক মুহূর্তে ভেঙে পড়ে।
  • সেতু ও রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়।
  • গ্যাস লাইন ফেটে গিয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে।
  • পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়, যা জনজীবনকে সংকটের মুখে ফেলে।

৩. ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন ও পরিবেশগত ক্ষতি

ভূমিকম্প শুধুমাত্র স্থাপনার ক্ষতি করে না, এটি ভূ-প্রকৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়।
  • ভূমিধস: পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধসের ফলে গ্রাম ও শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • নদী ও জলাধারের পরিবর্তন: ভূমিকম্পের ফলে নদীর প্রবাহ পরিবর্তিত হতে পারে, যা কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিপজ্জনক।
  • সুনামি: যদি ভূমিকম্প সমুদ্রের নিচে ঘটে, তবে বিশাল সুনামি সৃষ্টি হয়, যা উপকূলীয় অঞ্চল ধ্বংস করে দেয়।

৪. অর্থনৈতিক বিপর্যয়

  • ভূমিকম্পের ফলে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়।
  • ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থায়ী ক্ষতি হয়, কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়।
  • কৃষিজমির ক্ষতি হলে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।
  • সরকার ও সংস্থাগুলোকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় উদ্ধার ও পুনর্গঠন কার্যক্রমের জন্য।
  • কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে, যা জনগণের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলে।

৫. সামাজিক ও মানবিক সংকট

  • ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় সামাজিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
  • হাজারো মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে, যা আশ্রয়ের সংকট তৈরি করে।
  • ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর পুনর্বাসন ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়ে।
  • সাহায্য ও খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হলে স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রায় বিপর্যয় দেখা দেয়।

ভূকম্পনের মাত্রা ও স্থায়ীত্ব

ভূকম্পন মাপার দীর্ঘদিনের প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে রিখটার স্কেল। তবে, বর্তমানে রিখটার স্কেল পদ্ধতি ছাড়াও মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল নামক আরও একটি পদ্ধতির মাধ্যমেও ভূকম্পন মাপা হচ্ছে। রিখটার স্কেল পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ভুলভাবে ভূকম্পনের মাত্রা নির্ণয় করা অতিশয় সহজ হচ্ছে। যে পদ্ধতিতেই মাপা হোক নয়া কেন, মূলত ভূমিকম্পের মাত্রা বুঝতে যে সংখ্যাটি দেওয়া হয়, তা দিয়ে ফল্ট লাইন কতটুকু সরেছে ও যে গতি এই সরানোর পেছনে কাজ করেছে সেটিই নির্দেশ করে।

পৃথিবীর তলানি অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ট আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দ্বারা তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। যেসকল স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের নিকটবর্তী হয়ে মিশছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে ধরা হয় ফল্ট লাইন।
  • ভূ-পৃষ্টে ২.৫ বা তার কম কম্পন হলে মূলত তা অনুভূত হয় না, তবে যন্ত্রে নিশ্চিত ধরা পড়ে। 
  • ৫ মাত্রার বেশি কম্পন হলে মানুষ বুঝতে পারলেও এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সামান্য দেখা দিতে পারে।
  • ৭ মাত্রা বা তার অধিক ভূমিকম্পনকে বিপদজনক হিসেবে ধরা হয়। এটির স্থায়িত্বকাল বেশী হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
  • ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্পকে ভয়ংকর বড় দুর্বিপাক বলা হয়। এটির কারণে মানুষের জানমালের সীমাহীন ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

প্রতিকার

  1. ভূমিকম্পের সময় ভূপৃষ্ঠে বহু পরিবর্তন ঘটে, যা মানুষের জীবন, স্থাপনা, ও প্রকৃতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। ভূমিকম্পের ধ্বংসাত্মক প্রভাবের মোকাবিলা করতে উন্নত পূর্বাভাস ব্যবস্থা, সচেতনতা বৃদ্ধি, ও কার্যকরী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। বিশেষ করে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে স্থায়ী ও নিরাপদ অবকাঠামো নির্মাণ, দুর্যোগ প্রশমন পরিকল্পনা এবং মানুষের জীবন রক্ষার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে এর ক্ষতিকর প্রভাব কমানো সম্ভব।
  2. ভূমিকম্পের সময় ভূমির কম্পন চলনের মাত্রা ও ধরন নির্ভর করে ভূ-গর্ভস্থ শক্তি, ভূমির গঠন, এবং ভূমিকম্পের গভীরতার উপর। এই প্রক্রিয়াটি বুঝতে পারলে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে ঝুঁকি নিরূপণ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
  3. ভূমিকম্পের সিসমিক তরঙ্গ মানুষের জীবন ও প্রকৃতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে সচেতনতা বৃদ্ধি, শক্তিশালী অবকাঠামো নির্মাণ, এবং উন্নত পূর্বাভাস ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ধ্বংসাত্মক তরঙ্গের ক্ষতি কমানো সম্ভব।
  4. ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্বল অবকাঠামো, ভূ-গঠনের বৈশিষ্ট্য, জনসংখ্যার ঘনত্ব, এবং আনুষঙ্গিক দুর্যোগের সৃষ্টি। তবে উন্নত প্রযুক্তি, সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
পৃথিবীর আয়ুষ্কাল যতই বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে, ততই ভূমিকম্পের আশঙ্কা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের ও দেশের তুলনায় বাংলাদেশেও ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। ফলে, ভূমিকম্পের আতঙ্ক থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সর্বদাই সচেতন থাকাটা একান্ত জরুরি। প্রিয় পাঠক, আমরা আজকের আর্টিকেলটির মাধ্যমে যে কারণে ভূমিকম্প প্রবৃদ্ধি হয় সে বিষয়ে কিছুটা হলেও ধারণা পেলাম। আজকের আর্টিকেলটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সম্মানিত পাঠকবৃন্দ আমাদের সাথে এতক্ষণ সময় দিয়েছেন যার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আলোকবর্ষ আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুণ। প্রীতিটি কমেন্ট রিভিও করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪